
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় মানবাধিকার শুধু নীতির ধারণাই নয়,এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিপালনের বিষয়।মানবাধিকার মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অবস্থানের কারণে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা,স্বাধীনতা,সাম্যতা নিশ্চিত করে।মানবাধিকার দৈনন্দিন জীবনে পালন করা নৈতিক দায়িত্ব।
মানুষের জন্মগত মর্যাদা, স্বাধীনতা ও সমঅধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পায়।আধুনিক সভ্যতার দ্রুত অগ্রগতির যুগে আমরা প্রযুক্তিগত সাফল্যে সমৃদ্ধ হলেও মানবিকতা, সহমর্মিতা এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবে সমাজে একধরনের অস্থিরতা ও সংকট তৈরি হয়েছে।মানবিক শিক্ষার ঘাটতি মানবাধিকারের বাস্তব প্রয়োগকে কঠিন করে তুলেছে, যা আজ দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।
শিক্ষা শুধু তথ্য বা দক্ষতা অর্জনের মাধ্যম নয়; এটি মানবিক চেতনাকে বিকশিত করার একটি শক্তিশালী উপাদান। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা কাঠামোতে মানসিক গঠন, মূল্যবোধ চর্চা, সহনশীলতা ও নৈতিকতার শিক্ষা পর্যাপ্তভাবে অন্তর্ভুক্ত নয়।
ফলে—সহমর্মিতা কমে যাচ্ছে,ভিন্নমতকে সহ্য করার মানসিকতা দুর্বল হচ্ছে,
সামাজিক দায়বদ্ধতা হ্রাস পাচ্ছে,
এবং স্বার্থপরতা, অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার মতো আচরণ বাড়ছে।
যে শিক্ষা একজন মানুষকে “মানুষ” হিসেবে গড়ে তোলে, সেই শিক্ষা উপেক্ষিত হওয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে।
মানবিক শিক্ষার অভাব সরাসরি মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন রূপ প্রতিদিনের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যেমন—নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা,
ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন,
সাইবার বুলিং ও অনলাইন হয়রানি,রাজনৈতিক সহিংসতা,শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন,বিচারহীনতার সংস্কৃতি,পরিবেশ ধ্বংস ও ভূমিহীনতার সমস্যা।
এসব ঘটনার পেছনে শুধু আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা নয়, মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের অভাবই প্রধান কারণ। যখন একজন মানুষ শেখেন না অন্যের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি বা ন্যায়ের মূল্য, তখন যেকোনো সুযোগেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।
পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের ভূমিকা
একটি মানবিক ও অধিকারসম্মত সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
মানবিক আচরণ শেখার প্রথম বিদ্যালয় হলো পরিবার। সন্তানদের সামনে দায়িত্বশীল আচরণ, ন্যায়পরায়ণতা ও সম্মান প্রদর্শন দেখাতে হবে। বাবা-মা যদি মানবিকতার চর্চা না করেন, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও সেই শিক্ষা পাবে না।
স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-ভার্সিটিগুলোতে মানবিক শিক্ষা, নৈতিকতা, সহনশীলতা, চরিত্র গঠন, অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। শুধু পাঠ্যবই নয়, কর্মকাণ্ড, সহপাঠী সম্পর্ক, শিক্ষকতার আচরণ—সবই মানবিকতা শেখায়।
রাষ্ট্র তথা সমাজের অনেক দায় দায়িত্ব রয়েছে, আইনের সঠিক প্রয়োগ,সুশাসন প্রতিষ্ঠা,ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা,এবং মানবাধিকার রক্ষায় স্বচ্ছ প্রক্রিয়া বজায় রাখা।
সিলেবাসে মানবাধিকার, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও চরিত্র গঠনের পাঠ যোগ করতে হবে।
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানবিক প্রচার
সহিংসতা বা নেতিবাচকতার বদলে মানবিক গল্প, সহমর্মিতা ও উদাহরণ তুলে ধরা উচিত।
আইনের শাসন নিশ্চিত করা
বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হলে মানুষ আইন ও অধিকারকে সম্মান করতে শেখে।আরো কিছু কাজ যা মানুষকে মানবাধিকার শেখায় ; যুবসমাজকে মানবিক আন্দোলনে যুক্ত করা,ইয়ুথ ক্লাব, সমাজসেবা, রক্তদান, স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম মানবিক চেতনা তৈরি করে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকে মানবিকতা অনুপ্রাণিত করা,সব ধর্মেই মানবিকতার নির্দেশনা আছে—এই শিক্ষা বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।
মানবিক শিক্ষার অভাব শুধু একটি শিক্ষাগত সমস্যা নয়; এটি মানবাধিকার সংকটের প্রধান উৎস। নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সহমর্মিতার চর্চা ছাড়া কোনো সমাজই অধিকারসম্মত, নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক হতে পারে না।সবকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে,
মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে আগে মানুষের গড়ার কাজ করতে হবে অর্থাৎ মানবাধিকার শুধু একটি আইনের বিষয়ে নয় বা একটি দিবস পালনের বিষয় নয়। এটি একটি মনুষ্যত্ববোধের চেতনা। তাই আমরা বলতে পারি, মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজন্মই মানবাধিকার রক্ষার ভিত্তি।
(লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক)